ব্রাহ্মণবাড়িয়া.প্রেসঃ- মানবজমিন ডেস্ক, মোঃ বিজন। এবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শফিকুল আলম এবং জেলা আওয়ামী লীগ উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য আমানুল হক সেন্টুর বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দিয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকার। মামুনকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বলায় এবং বিজয় দিবসে মুক্তিযোদ্ধা সংবর্ধনা অনুষ্ঠানস্থলে হামলার জন্য দায়ী করায় এই অভিযোগ দিয়েছেন তিনি। সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. সেলিম উদ্দিন শুক্রবার অভিযোগটি পেয়েছেন জানিয়ে বলেন বিষয়টি নিয়ে তারা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলছেন। আল মামুন সরকারও অভিযোগ দেয়ার কথা স্বীকার করেন। অভিযোগে সাম্প্রতিক ঘটনা তাদের নেতৃত্বে হয়েছে এবং তাকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বলার বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে বলে জানান মামুন। মামুন আরো জানান- শফিকুল আলম এবং আমানুল হক সেন্টু উকিল নোটিশের জবাব না দেয়ায় তাদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ দিয়েছেন তিনি। তবে এখনো অভিযোগটি মামলা হিসেবে রেকর্ড হয়নি বলেও জানান তিনি। তবে আমানুল হক সেন্টু ও শফিকুল আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা দু-জনেই উকিল নোটিশের জবাব দিয়েছেন বলে জানান।
শফিকুল আলম বলেন, শত্রুতামূলক থানায় এই অভিযোগ দেয়া হয়েছে। সেন্টু বলেন- ১৬ই ডিসেম্বরের ঘটনা দিবালোকের মতো সত্য। আসলে এতে মোক্তাদির চৌধুরী দায়ী নন। তিনি অসুস্থ অবস্থায় বাড়িতে ছিলেন। কিন্তু তার নাম ভাঙিয়েছে আল মামুন সরকার। ওই ঘটনা সম্পূর্ণ তার নিজ দায়িত্বেই ঘটিয়েছে। ঘটনার পরক্ষণেই সে অনেকের কাছে মন্তব্য করেছে জেলা প্রশাসন একটা অনুষ্ঠান করছে। সেখানে জেলা পরিষদ কেন ওইসময়ে আরেকটা অনুষ্ঠান করতে গেল। এতেই প্রমাণিত হয় তার ইচ্ছায় এবং সহযোগিতায় ঘটনা ঘটানো হয়েছে। তবে বিষয়টি নিয়ে সরকার দলীয় নেতাদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে জল ঘোলা হয়েছে আরো আগেই। থানায় অভিযোগ দেয়ার আগে শফিকুল আলম এবং আমানুল হক সেন্টুকে একই কারণে উকিল নোটিশ পাঠান আল মামুন সরকার। নোটিশের জবাবও দেন ওই দুই নেতা। এরআগে মানবন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন মামুন । ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবসে জেলা পরিষদ আয়োজিত মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা ও আলোচনা অনুষ্ঠানস্থলে হামলার ঘটনায় জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকারকে দায়ী করে গণমাধ্যমে বক্তব্য দেন জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শফিকুল আলম ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা আমানুল হক সেন্টু। পরদিনই ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে মামুন ওই ঘটনায় তাকে জড়িত করার প্রতিবাদ জানান। সেসময় তিনি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শফিকুল আলম ও জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা আমানুল হক সেন্টু প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নন বলে বক্তব্য দেন। জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শফিকুল আলম ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা এবং আমানুল হক সেন্টু নামধারী মুক্তিযোদ্ধা বলে মন্তব্য করেন মামুন। সেন্টুর দুই ভাই স্বাধীনতা বিরোধী ছিলেন বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এরপর ২৩শে ডিসেম্বর ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে করা এক মানববন্ধনে মামুন আবারো এ বিষয়ে বক্তব্য দেন। তবে মুক্তিযোদ্ধা আসল না ভুয়া এনিয়ে তাদের লড়াই চলছে আড়ালে আরো আগে থেকে। বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে হামলার জন্যে অভিযুক্ত হওয়ার পর বিষয়টি সামনে নিয়ে আসেন মামুন।
লিগ্যাল নোটিশ ও পাল্টা জবাবে: দু-আওয়ামী লীগ নেতার স্বজন রাজকার ছিলেন বলে লিগ্যাল নোটিশ ও পাল্টা জবাবে তুলে ধরা হয়। আমানুল হক সেন্টু ও শফিকুল আলমকে গত ২৬শে ডিসেম্বর জেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপি ও সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকারের পক্ষে লিগ্যাল নোটিশ পাঠানো হয়। এডভোকেট আবদুল জব্বার (মামুন) স্বাক্ষরিত ওই নোটিশে আমানুল হক সেন্টুকে স্বাধীনতা বিরোধী পরিবারের সন্তান উল্লেখ করে বলা হয় তার ভাই হামিদুল হক টুক্কু ছিলেন চিহ্নিত ও তালিকাভুক্ত রাজাকার নেতা। যিনি যুদ্ধাপরাধ মামলায় কারাগারে ছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়। জেলা পরিষদে ১৬ই ডিসেম্বর সংগঠিত ঘটনা ছাড়াও নাসিরনগরসহ আরো কিছু সাম্প্রদায়িক ঘটনায় নোটিশ দাতাদের জড়িত করে দেয়া বক্তব্যকে মিথ্যা, ভিত্তিহীন, অশালীন, নিন্দনীয় এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত উল্লেখ করা হয়। কোন প্রকার স্বাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়া জনসমক্ষে এবং রাজনৈতিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে তাদেরকে জড়িত করে এ ধরনের বক্তব্য দেয়া হয়েছে বলে বলা হয় নোটিশে। এধরনের বক্তব্য প্রত্যাহার করে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে বলা হয়। নোটিশে র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এবং আল মামুন সরকারের রাজনৈতিক পরিচয় এবং ত্যাগ-তিতিক্ষার বিবরণ ছাড়াও তারা দু-জনেই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা বলে উল্লেখ করা হয়। এরমধ্যে আল মামুন সরকারকে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধে ভোগী মুক্তিযোদ্ধা উল্লেখ করে বলা হয় তিনি বীরত্বের সাথে স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযোদ্ধ করেছেন।
১২ই জানুয়ারি এডভোকেট শওকত আলীর মাধ্যমে এই লিগ্যাল নোটিশের জবাব দেন আমানুল হক সেন্টু ও শফিকুল আলম। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এই পরিচয় দিয়ে সেন্টুর জবাবে বলা হয়, ২ বছর বয়সে তার পিতৃবিয়োগে তার মা তাকে নিয়ে নানার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরতলীর বিজেশ্বর গ্রামে বসবাস করতে শুরু করেন। মুক্তিযোদ্ধের সংগঠক এবং জেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সভাপতি প্রয়াত আলী আজম ভূইয়া ছিলেন তার নানা এবং মুক্তিযুদ্ধে ৩নং সেক্টরের গেরিলা উপদেষ্টা এবং জেলা আওয়ামী লীগের আরেক সভাপতি প্রয়াত লুৎফুল হাই সাচ্চু তার মামা। তাদের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে স্কুল জীবন থেকেই তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত হন এবং স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তির পরিবারে লালিত পালিত হন। সৎভাই হামিদুল হক টুক্কুর পরিবারের সংস্পর্শে তিনি বড় হননি।
নোটিশে আল মামুন সরকারের মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় নিয়ে বলা হয়, জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী তার জন্ম তারিখ ১৯৫৮ সালের ১লা মার্চ। সুতরাং স্বীকৃত মতেই মুক্তিযোদ্ধের সময় আল মামুন সরকারের বয়স ছিলো আনুমানিক ১২ বৎসর। তাছাড়া তিনি কখন কোথায় কিভাবে মুক্তিযোদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছেন তার কোন তথ্য মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় বা সংশ্লিষ্ট কোন শাখায় নেই। তিনি কোন যুদ্ধে আহত হয়ে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন তারও কোন তথ্য কোন সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধার কাছে নেই। তাছাড়া তার শারিরীক গঠনশৈলীতে ১২ বছর বয়সে কতটুকু শক্তিশালী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তা সহজে অনুমান করা যায়। ইদানিং তিনি মাননীয় সাংসদের সাথে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিয়ে তার কাতারে নিজেকে উপস্থাপনের চেষ্টা করছেন উল্লেখ করে নোটিশে বলা হয়, কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের সকলেই জানেন যে আল মামুন সরকার স্বাধীনতা পরবর্তীকালে মরহুম হুমায়ুন কবিরের নির্বাচনী প্রচারণায় মোটরসাইকেলের চেইনে লেগে পায়ে ব্যথা পান। আল মামুন সরকার মুক্তিযোদ্ধা, একে মনগড়া কাহিনী উল্লেখ করে তার মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিলের জন্যে মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে বলেও নোটিশে উল্লেখ করা হয়। আল মামুন সরকারের শ্বশুর ফরিদ উদ্দিন আহমেদ ওরফে ফরিদ মিয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের একজন প্রখ্যাত রাজাকার ছিলেন এবং স্বাধীনতা পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর খুনি খন্দকার মোশতাকের বিশ্বস্ত সহচর ছিলেন বলে সেন্টু তার নোটিশের জবাবে উল্লেখ করেন। জেলা পরিষদের অনুষ্ঠানে হামলার জন্যে মামুনকে দায়ী করে নোটিশে বলা হয় নিজের ক্ষমতা জাহির করতে নিজে আড়ালে থেকে সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে ১৬ই ডিসেম্বর জেলা পরিষদে হামলার ঘটনা ঘটিয়েছেন। অন্যদিকে শফিকুল আলমকে বীর মুক্তিযোদ্ধা উল্লেখ করে তাকে দেয়া লিগ্যাল নোটিশের জবাবে জানানো হয়- ১৯৯৬-২০০১ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নীতিমালা অনুযায়ী সরজমিন যাচাই-বাছাইয়ের পর তাকে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে গেজেট প্রকাশ করা হয়। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ দফা যাচাই-বাছাইয়ের পর তার নাম মুক্তিবার্তার লাল বহিতে অন্তর্ভুক্ত হয়। যার মুক্তিবার্তা নং ০২১২০১০৯৬৭। এছাড়া তাকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতিস্বাক্ষরিত মুক্তিযোদ্ধা সনদপত্র প্রদান করা হয়। যার নম্বর ৪৪১৬৮। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বেসামরিক গেজেটেও তার নাম লিপিবদ্ধ রয়েছে। যার গেজেট নম্বর ৪৩১২। মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের সনদপত্রও রয়েছে তার। যার নম্বর ৯৩৮৭৯। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানীর স্বাক্ষরিত সনদপত্র এবং মুক্তিযোদ্ধে ব্যবহ্নত অস্ত্র জমা দেয়ার রশিদও রয়েছে শফিকুল আলমের। শফিকুল আলম প্রথমবারের মতো নির্বাচিত জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান উল্লেখ করে বলা হয়, তার জনপ্রিয়তায় ইর্ষান্বিত হয়ে তার রাজনৈতিক কর্মকান্ডে হয়রানি করা হচ্ছে।